- দীপক মুখোপাধ্যায়
চায়ের দোকানে পাড়ার লোকজনের মধ্যে আচমকা মধু ঘোষ ঢুকে খবর দিলো । এসব খবর চাপা থাকে না । হাওয়ার আগে ছোটে । মধু ঘোষ না দিলে অন্য কেউ খবরটা দিতো । সকালের পাঁচ পাবলিকের আড্ডা ভেঙ্গে গেলো । সবচেয়ে বড় কথা এই গ্রামে এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি ।
জটলা থেকে একটূ আলাদা ডেকে মাধব সর্দার জিজ্ঞেস করলো কুতায় ? মধু ঘোষ কথাটা ঠিকমতো ধরতে না পেরে বললো এ্যাঃ ?
বলছি আরে জায়গাটা কুতায় ? মধু ধরা গলায় বললো , পচা পুকুরের ধারে ।
কথাটা শোনার পর সবাই পড়ি মরি কোরে ছুটলো ।
মধুর পায়ে বাত । সে একটু খুঁড়িয়ে হাঁটে । সবার পেছনে মাধব আর মধু ।
চায়ের দোকান থেকে আধ কিলো মিটার মতোন দূর পচা পুকুর ।
সব বাড়ী থেকে দু -চারজন লোক বেরিয়ে এসে ওদের সঙ্গে যোগ দিলে বেশ একটা মিছিলই হয়ে গেলো ।
সোনা ঘোষ পঞ্চায়েতের সদস্য । তার একটা আলাদা সম্মান আছে গাঁ ঘরে ।সোনা ঘোষের পেছনে এক দঙ্গল ছেলে ।
সোনাকে সবাই মেম্বর বলে ডাকে । সামনে
যারা দাঁড়িয়ে ছিলো তারা সরে গিয়ে সোনার যাওয়ার রাস্তা প্রশস্ত কোরে দিলো ।
মেম্বার অবশ্য বেশিক্ষণ থাকলো না । দূর থেকে দেখে তার লোকদের নিয়ে বেরিয়ে গেলো ।
এখন সকাল সাত টা । মসজিদে আজ বিশেষ প্রার্থনা ছিলো । আজ শুক্রবার ।
আজান শেষ হলে শামসুদ্দিন বদনা থেকে পানি নিয়ে হাত মুখ ধুয়ে পবিত্র হয়ে লম্বা শুভ্র দাড়িতে হাত বুলিয়ে আকাশ পানে তাকিয়ে রইলো । আর একবার আল্লাহর কাছে শাদা টুপি পরে সে প্রার্থনায় বসবে। গ্রামের মসজিদে দীর্ঘসময় কেউ প্রার্থনার জন্য নষ্ট করে না । সবাই নামাজ পড়ে বেরিয়ে গেলে তিনি একটু নিরিবিলিতে বসেন । নির্জনতা তার খুব প্রিয় । শামসুদ্দিন সমগ্র মানব জাতির মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করেন । অশীতিপর এই মানুষ টা বিশ্বাস করেন ঈশ্বর আল্লাহ সব এক । তিনি বলেন মানুষ বিপদের দিনে মানুষের পাশে থাকবে না তো কে থাকবে বাপু । কোরআন পুরান সব এক ।
পাঁচ কান হতে হতে এহেন মানব প্রেমী শামশুদ্দিনের কানেও খবর টা আছড়ে পরল।
সে একেবারে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো । ধীরে ধীরে তার মাথা ঝুঁকে পরলো । তিনি নতমস্তকে দাঁড়িয়ে রইলেন । বুকের ভেতর জমাট বাঁধা শ্বাস ছাড়লেন নিঃশব্দে । আবার তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে দু বাহু তুলে দিলেন । আল্লাহর কছে দরবার করে বললেন তুমি ফেরেস্তাদের সাজা দিও । তার চোখ দুটো বাস্পাছন্ন হোলো ।
এ ছাড়া বৃদ্ধ শামশুদ্দিনের আর কিছু করারও ছিলো না । তিনি ঈদগার গৃহে শ্লথ পায়ে হেঁটে প্রবেশ করলেন ।
রক্তাক্ত , বিবস্ত্র , স্তনের ওপর দংশনের ক্ষত চিহ্ন । চিৎ হয়ে রয়েছে নিথর দেহ । যোনী মুখ থেকে
কালচে গড়িয়ে যাওয়া রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে । ঠোঁটের অনেকটা মাংস খুবলে নেওয়ায় দাঁত আর মাড়ি অনাবৃত হয়ে আছে । ভয়াবহ হয়ে আছে মুখমন্ডল । শরীর থেকে খুলে নেওয়া পোশাক ছড়িয়ে আছে ইতস্ততঃ , শুধু ওড়নার ছেঁড়া টুকরো পরে রয়েছে মাথার পাশে । ক্ষত বিক্ষত বছর চোদ্দো কিশোরীর শরীর ।
নদী থেকে শাখা হয়ে বেড়িয়ে শীর্ণতোয়া বিল শীর্ন হতে হতে থেমে গেছে । এখন পায়ের পাতা ডোবা জল ।মরা কচুরী পানা , কাদা , দুর্গন্ধ ময়
মৃত পশুর শব , শ্যাওড়ার জঙ্গল । মুথো ঘাস , বেনা বন , এর ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে কাশ ফুলের শুভ্রতা । বাতাস এখানে এখন ভারী হয়ে আছে ।
গ্রাম থেকে আরোও গ্রাম , লোক আসে , দ্যাখে এবং চলে যায় । শরতের মেঘেরা আকাশে ঘুরে বেড়ায়। পেঁজা তুলোর মতন , কখনও বা দল বেঁধে চলে যায় আকাশের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে। এখন ঘুঘু ডাকা ক্লান্ত দুপুরে লোকজনের ভিড় পাতলা । জনা দশেক লোক বসে আছে বটের ছায়ায় । সকলের বিষয় ভাবনা এক । ঘটনার নিপুন বিন্যাসে তারা ব্যস্ত । ঘটনাটা কাল রাতে ঘটেছে । কখন ঘটেছে কেউ জানে না । চর্চা চলছে । দূর্গার বাবা বলছে সন্ধ্যের পর তার মেয়ে একবার বাইরে বেরিয়েছিলো । পাসের বাড়ি টিভি দেখতে । তারপর রাত বাড়লে তার খোঁজ পরে দূর্গার । সকালে দূর্গার বাপকে দুঃসংবাদটা শোনায় ঐ মধু ঘোষ । সেই সাত সকালে বেরিয়ে যায় দূর্গার বাপ । এখনও সে ফেরেনি ।
প্রথম দেখা করলো দয়াল মালোর সঙ্গে ।
কি খবর রে সুবল ? এতো ভোরে ।
দয়াল মালো বিস্তারিত বিবরন মনোযোগ দিয়ে শুনে দুই আঙ্গুল দিয়ে চোয়ালের রগ চেপে ধরে চোখ বুঁজে রইলো কিছুক্ষন । চোখ খুলে বললো তুমি থানায় যাও । আমি একটু পরে যাচ্ছি ।
সুবল দুপা এগিয়ে গেলো । সে এখন থানায় যাবে । চোখের পাতার ওপর নরপিশাচদের হাতে ধর্ষিতা খুন হয়ে যাওয়া দুর্গার মুখ । এসব কথা ভাবতে ভাবতে আরো দু' পা এগিয়ে গেলো ।
এই সুবল একবার শোনো তো ।
সুবল প্রধানের ডাক শুনে পেছন ঘুরে দাঁড়ালো ।
প্রধানের কাছে গেলে বললো , কিচু মনে করো না । দিনকাল খারাপ জানোই তো । মেয়েকে সাবধানে রাখতে পার নি । তারপর গলার স্বর নিচু করে বললো , আচ্ছা অ্যাতো রাতে তোমার মেয়ে কি করছিলো। স্বভাব চরিত্র কেমন ছিলো তোমার মেয়ের ।
এত দুঃখ কষ্টের মধ্যেও তার কণ্ঠস্বরে অসন্তোষ ঝরে পড়লো । সে নিজেকে সংযত করে বললো আজ্ঞে মেয়ের বাপ হয়ে আর কি বলবো । আপনি বরং পাড়ায় খোঁজ নিয়ে জানুন । আমি তো কোনো বেচাল দেখিনি কখনো। কথা কটা বোলে সে ঝিম্ মেরে দাঁড়িয়ে থাকলো । সে অপেক্ষা করতে লাগলো প্রধানের পরের প্রশ্নের জন্য ।
আচ্ছা যাও ।
অন্য সময় হোলে এসব প্রশ্নের জবাব এতো সহজ ভাবে দিতো না । আজ তার সময় খারাপ । সুবল দুঃখ আর অভিমান নিয়ে প্রধানের বাড়ি থেকে দ্রুত বেড়িয়ে থানার পথ ধরলো ।
সকাল থেকে পেটে দানা পানি নেই । শোকাহত পিতা থানার দরজার সামনে বসে । সেপাইটা ভালো । বড় বাবু কখন আসবে ঠিক নেই । তোমার ওসব কেস যে কেউ লিখতে পারবে না । তার চেয়ে বরং কিছু খেয়ে টেয়ে এসো । এতো
দুঃখের মধ্যেও দূগ্গার বাপ ভেতরে হেসে উঠলো । তার টাকা পয়সা কিছু নেই । খাওয়ার ইচ্ছাও নেই ।
থানায় বড়বাবু ঢুকলেন যখন , তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেলের শুরু । হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে বড়বাবুকে ঘটনার বিবরণ দিলো । খাতায় লিখে নিলেন তিনি ।
বড়বাবু বললেন , পাড়ায় তোমার মেয়ের বয়েসী আর মেয়ে আছে ?
হ্যাঁ তা আছে ।
তাহলে তোমার মেয়ে রেপ হতে গেলো কেনো ? রেপ তো এমনি হয় না । কি রকম পোশাক পরতো ?
আজ্ঞে আমরা গরীব মানুষ বাবু । ভালো করে দু মুঠো খেতে পায় না ।
যাও । থানার গাড়ি যাবে । ওখানে উপস্থিত থাকবে ।
বাতাসে খবর আটকে আছে । দুগ্গা রেপ হয়েছে । যারা তখনও বসে ছিলো তারা সব নড়ে চড়ে বসলো । পুলিসের জিপ থেকে নেমে বড়বাবু মেপে নিলেন পরিস্থিতিটা । একটূ চোখ বুলিয়ে নিলেন বসে থাকা লোক গুলোর ওপর।
কে প্রথম দেখছে মেয়েটাকে এরকম অবস্থায় ।
আজ্ঞে আমি । মধু ঘোষ খুব বিব্রত গলায় বললো ।
কখন দেখেছো ?
খুব ভোরে । ত্যাকন সূর্য ওটেনি ।
তা ওই অত ভোরে তুমি কি করছিলে এখানে ?
আজ্ঞে বাহ্য ।
চোপ শালা হারামী । ধরে চালান করে দেবো । পুলিসের সঙ্গে ইয়ার্কি ।
মধুর গলা শুকিয়ে কাঠ । মাথা ঘুরে পরে যাওয়ার উপক্রম । বড়বাবুর ধমক খেয়ে মধু মাটির দিকে তাকিয়ে ।
বলো , বলো ঠিক কি করতে এসেছিলে ।
আজ্ঞে বললাম তো । ঐ ইয়ে মানে ........। বলতে গিয়ে গলায় কথা আটকে গেলো ।
সত্যি বলছো তো ।
মধু ঘাড় কাত করে সম্মতি জানালো ।
গাড়িতে দুর্গার লাশ উঠছে । মেডিকেল হবে তারপর ময়না তদন্ত ।
সুবল কৈবর্ত উন্মাদের মতো চিৎকার করে উঠলো । না না না দূর্গাকে তুমরা লিয়ে যেতে পারবা না । তার হৃদয় বিদারক চিৎকারে পুলিস একটু ঘাবড়ে গেলো । বড়বাবু দুজন কনস্টেবলকে ইশারা করলেন। তারা তাকে চুলের মুঠি ধরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো ।
পুলিসের গাড়ি দূর্গাকে নিয়ে বেড়িয়ে গেলে, প্রধান সাহেব সুবলের কাছে এসে কাঁধে হাত রাখলো ।
সুবল প্রায় কোকিয়ে উঠলো । পরধান তুমি দেখল তো মা মড়া মেয়ে টাকে লিয়ে পুলিস চলে গেলো ।
সুবল তার মেয়েকে ফিরিয়ে আনবার জন্য পুলিসের জিপের পিছনে প্রানান্ত দৌঁড়তে লাগলো ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন