সামান্যটাই ব্যাক্তিগত

দীপ্তনীল ব্যানারজী 


আজ তো আর বসতে হবে না, তাই একদমই চলনসই একটা সালোয়ার পড়ে লোকটার সামনে এল নাসিফা।

এখনও ভালোমত খুঁড়িয়ে হাঁটে নাসিফা। তিন বছর আগে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে যাওয়ার পর মাসি লাল্লন কে দিয়ে পেরেক পুঁতে দিয়েছিল পায়ের পাতায়। সারা জীবন এখন এভাবেই চলতে হবে। এমনিতে মাসি লোক খারাপ নয় তবে এখানে এই অপরাধের এটাই শাস্তি। তো কিছু বলার নেই।

ঘরে ঢুকে লোকটাকে দেখে খারাপ লাগলোনা নাসিফার। হাসি পেলো যখন দেখল ওকে দেখে উঠে দাঁড়িয়েছে লোকটা ।

হাসতে হাসতেই বললঃ

"কি নেবেন, চা না ঠাণ্ডা?"।

অরিন্দমও এরকম ভদ্রতায় একটু ঘাবড়ে গেল। সামলে নিয়ে বললঃ

“না, না কিছু লাগবে না। আপনি অনুমতি দিলে শুরু করি?”।

এবার বেশ শব্দ করে হেসে ফেলল নাসিফাঃ

“মাসি আপনার কথা বলেছে। অনুমতি দিলাম। বলুন কি জানতে চান?”।

অরিন্দমঃ “কতদিন আছেন আপনি এখানে? কিভাবে এলেন? কোন জবরদস্তি?”।

তখনও হাসিটা লেগে নাসিফার মুখে।

নাসিফাঃ “আছি বেশ অনেক বছর। নিজের ইচ্ছেতেই এসছি। টাকা পয়সা দরকার ছিল অনেক, আর গুন তো কিছু ছিলনা, বিদ্যে বুদ্ধিও বিশেষ নেই। তাই ভাবলাম ভগবানের দেওয়া দানের ই সদব্যবহার করি। এদিকে কলকাতার কিছু চিনতাম না। আমাদের হাসনাবাদের ওদিকে অনেক দালাল আছে। যোগাযোগ হয়ে গেল, চলে এলাম।”।

অরিন্দমঃ “ওহ! তার মানে আপনি ভালো আছেন? এতদিনে কোন খারাপ অভিজ্ঞতা?”।

নাসিফাঃ “না। এখনও তেমন কিছু নেই। আসলে মাসি মোটামুটি বাছা বাছা খদ্দের ই রাখে আমার জন্য। ভদ্র। খারাপ কিছু হয়নি কখনো।”।

অরিন্দমঃ “তাহলে কখনো বেরনোর ইচ্ছে হয়না এখান থেকে?”।

নাসিফাঃ “নাহ! কোথায় আর যাবো? ভালোই তো চলে যাচ্ছে।”।

“কোথায় যাবো কেন বলছেন? কেউ নেই আপনার বাড়িতে?”।

নাসিফাঃ “আছে তো। মা, বাবা, একটা ভাই দুটো বোন। যেমন গ্রামের বাড়িতে হয় আর কি।”।

“চলে কি করে তাদের? কার আয়ে?”

নাসিফাঃ “চলে যায়। একটু জমিজমা আছে বাবার। ভাইও কাজ করে টুকটাক। মা লোকের জমিতে ফসল তোলে। সব মিলিয়ে হয়ে যায়। আমার আয় তো আমার নিজের আছেই।"।

এবার অরিন্দম একটু সমস্যায় পড়ল। আর কথা খুঁজে পাচ্ছিল না। কিছুটা সময় নিয়ে জোর করেই জিজ্ঞাসা করলঃ

অরিন্দমঃ "খোঁড়াচ্ছেন কেন?"।

উত্তর না দিয়ে দুটো সেকেন্ড অপেক্ষা করল নাসিফা।

নাসিফাঃ "আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব? আপনি তো কাগজে লেখালিখি করেন, তাই না? সে তো খুব ভালো কাজ। তাহলে আমার কাছে কেন।"।

অরিন্দমঃ "আসলে আমাদের কাজ ই হল সমাজের সব মানুষের গল্প অন্যের কাছে পৌঁছে দেওয়া। আজ যদি আপনি খুব কষ্টে থাকতেন হতে পারত আমার এই লেখা পড়ে সবাই এগিয়ে আসত সাহায্যের জন্য।"।

নাসিফাঃ "কিন্তু সে তো আপনি নিজেই সব শুনছেন, দেখছেন। আমি ভালো আছি, কিন্তু কাজ টা তো ভালো কিছু নয়। কিছু করুন, লোকাল থানায় জানান।"।

অরিন্দমঃ "আসলে আমাদের কাজের একটা ধরন আছে। আমরা চাই...।"

হাত দেখিয়ে থামিয়ে দিলো নাসিফা।

নাসিফাঃ "হুম। বুঝেছি। কিছুদিন আগে একবার একসাথে দুজন বসে। এমনি ভালো লোক, কিন্তু নেশার ঘোরে একটু বেশী আদর করে ফেলে। সামলাতে পারিনি। পা টায়ে আঘাত লেগে যায়। তাই এই খোঁড়ানো।"।

অরিন্দমঃ “আপনি যদি এখান থেকে বেরোতে চান তাহলে কিন্তু...।”।

আবার অরিন্দম কে মাঝপথে থামায় নাসিফা। পায়ের আঙুল দিয়ে আর এক পায়ের শুকিয়ে যাওয়া কাটা জায়গাটা একবার বুলিয়ে নেয় অগোচরে।

নাসিফাঃ “এই কদিনেই বেশ তিন চারজন আমায় বের করতে চেয়েছিলেন এখান থেকে। আমি রাজি হইনি। বেশ তো আছি। আবার কি দরকার?”।

ফোন বেজে ওঠে নাসিফার, একবার দেখে সাইলেন্ট করে দেয়। আর একবার অরিন্দমের দিকে খুব মিষ্টিহেসে জিজ্ঞেস করে

নাসিফাঃ "বলুন আর কি জানতে চান?"।

স্পষ্টতই হতাশ অরিন্দম বলে

অরিন্দমঃ "নাহ! আর তেমন বিশেষ কিছু না। উঠি এবার।"।

নাসিফাঃ "সে কি? মাসি যে বলল দুঘণ্টার টাকা দিয়েছেন? এখন তো এই সবে চল্লিশ মিনিট। আমার কিন্তু মনে হয়না মাসি ওই টাকা ফেরৎ দেবে আবার।"।

অরিন্দমঃ "সে ঠিক আছে। কিন্তু এই গল্পটা ঠিক...।"।

নাসিফাঃ "হুম। আমার শরীরটার ঠিক বিপরীত। সেরকম উচু নিচু নেই। আপনার ভালো লাগলো না বোধহয়।"।

অরিন্দমঃ "না না সেরকম নয়। আপনি কি করবেন? আমার জন্য কি আর গল্প বানাবেন না কি? আসলে আমাদের অনেক গুলো কেস আলোচনা করে কিছু একটা বাছতে হয়।"।

নাসিফাঃ "ওহ! সে আপনার কাজ নিশ্চয়ই আপনি ভালো জানবেন। আসুন তাহলে।"।

অরিন্দমঃ "হুম! উঠলাম, আচ্ছা এটা ঠিক প্রশ্ন নয়, কৌতূহল বলতে পারেন, আপনার আসল নাম কি?"।

একটু কি কালো হল মুখটা নাসিফার? হয়ত না। কিন্তু যখন মুখ খুলল গলায় স্পষ্ট ক্লান্তির ছাপ।নাসিফাঃ "এটাই নাম আমার। আসল আর নকল।"।

অরিন্দমঃ "বাড়িতে জানে, আপনি কি করেন?"।

নাসিফাঃ "নিশ্চয়ই।"।

অরিন্দম বেরিয়ে যেতে দরজা বন্ধ করে পাঁচ মিনিট মাথায় হাত দিয়ে বসে রইল নাসিফা। পরের শিফট সন্ধে সেই সাতটা। অনেক টা সময় হাতে। ওহো! কথা বলার সময় অনেকবার বাড়ি থেকে ফোন করছিল। এখনি শুনে নেওয়া যাক কি বলছে। নাম্বার টিপল নাসিফা।

নাসিফাঃ "হ্যাঁ ভাই তাড়াতাড়ি বল। তোরা ভালো তো? আরে এমনি ফোন করার কি মানে? কোন দরকার ছাড়া? তোকে বলেছি না বাড়িতে বলতে যে এখন কাজের চাপ থাকে খুব? দেখছিস তো আগের দুদিন রাতে অব্ধি কথা বলতে পারলাম না অফিসে থাকতে হচ্ছে বলে। আর মোটামুটি সাতদিনের মধ্যেই টাকা টা পাঠিয়ে দেব। ভালো থাকিস। রাখছিরে।”।

ভাই কিছু একটা বলতে চাইছিল তার আগেই রেখে দিলো ফোন টা।

আবার হেসে ফেলল। গোটা গল্পে একমাত্র নিজের নামটাই সত্যি বলেছে নাসিফা। আর সেটা নিয়েই কত সন্দেহ লোকটার।

নিশ্তিন্তে নিজের সঠিক নাম টা বলতে পেরেছে নাসিফা। এই গল্প কোনোদিন কাগজে আসবে না। খুব ভালো জানে নাসিফা। সুখী বেশ্যার জীবনকথার জন্য খবরের কাগজে জায়গা হয়না।

নাসিফাদের পেশায় আনন্দটা বিক্রি হয় আর অরিন্দমের লেখার পাঠকরা পয়সা দেয় দুঃখ কিনতে।

লোকটার কথাটা কানে ভাসছে নাসিফার।

"...আমার জন্য কি আর গল্প বানাবেন না কি?"

সত্যিই গল্পই বানাল নাসিফা। বেশ্যাদের ভবিষ্যৎ হয় না। বর্তমান বাঁচে খদ্দেরের তৃপ্তি তে। অতীত টা না হয় চা এর আড্ডা আর চপের ঠোঙ্গার থেকে অনেক দুরে নিজেরই ব্যাক্তিগত থাক। বারো বছর আগের সদ্য বিক্রী হয়ে আসা কিশোরীটার তখনকার পরম যত্নে রক্ষা করা সতীচ্ছদের মতই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন